চন্দ্রবর্মার প্রতিশোধ: হরিকেল রাজ্যের হারানো বীরত্বের গল্প

 

🪶 ভূমিকা: বাংলার হারিয়ে যাওয়া সিংহাসন

 ইতিহাসে আমরা অনেক রাজ্যের নাম জানি — পাল, সেন, গুপ্ত। কিন্তু একটি নাম প্রায় হারিয়ে গেছে কালের ধুলায় — **হরিকেল**। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছিল এই হরিকেল রাজ্য। এ রাজ্যের শেষ প্রজন্মের গল্প ইতিহাসের বইয়েও খুব একটা লেখা হয়নি।

 

আজকের গল্প সেইরকমই এক বিস্মৃত রাজপুত্র **চন্দ্রবর্মা**-র, যার চোখে ছিল বাবার হত্যার প্রতিশোধ আর মাটির নিচে চাপা পড়া এক গৌরব ফিরে পাওয়ার আগুন।

  

## অধ্যায় ১: রাজভবনের রক্তস্নান

খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দী। হরিকেল রাজ্যের রাজধানী ছিল **বৃকুটিনগর**। রাজা **শ্রেণীবর্মা** ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক, কিন্তু রাজ্যজুড়ে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা, পার্শ্ববর্তী রাজ্য সমন্তদের ষড়যন্ত্র চলছিল জোরে।

 

এক রাতে রাজভবনে ঘটে যায় বিপর্যয়। বিশ্বাসঘাতকতা, গৃহদ্রোহ আর বাইরের আক্রমণে রাজা নিহত হন। রাণী কল্পনা দেবী ছেলেকে — মাত্র ৮ বছর বয়সী চন্দ্রবর্মা-কে — নিয়ে পালিয়ে যান গভীর জঙ্গলে।

 

সেই রাতেই শেষ হয় হরিকেল রাজবংশের প্রকাশ্য ইতিহাস।

  

## অধ্যায় ২: বনবাস — একজন রাজপুত্রের অন্য শৈশব

 

জঙ্গলের ভেতর, একটি ক্ষুদ্র আশ্রমে চন্দ্রবর্মার জীবন কাটে পরিচয়ে ঢাকা পড়ে। তিনি বেড়ে ওঠেন সাধারণ গ্রাম্য বালকের মতো — কিন্তু বুকে ছিল তীব্র ক্ষত আর লালায়িত দৃষ্টি। মা কল্পনা দেবী তাঁকে নিয়মিত শিখিয়ে যেতেন:

 

**"শত্রুদের রক্ত দিয়ে রাজ্য ফেরাতে হয়, কিন্তু তার আগে নিজের অস্ত্রকে শুদ্ধ করতে হয়।"**

 

চন্দ্রবর্মা তরবারি চালানো, ঘোড়সওয়ারি, রাজনীতি, সংস্কৃত ভাষা — সব শেখেন গোপনে। তিনি জানতেন, একদিন তাকে ফিরতে হবে — একদিন তাঁকে রাজ্য ফেরাতে হবে।

  

## অধ্যায় ৩: শত্রুর উত্থান ও প্রজাদের কান্না

 

যারা রাজাকে হত্যা করেছিল, তারা পরে নিজেরাই রাজ্য ভাগ করে নেয়। ভাগাভাগি হয় **তিন কুলীন জমিদার ও এক পরশ্রীকাতর ভ্রাতৃব্য** — নাম ছিল **বল্লভসেন**। বল্লভসেন ছিল শ্রেণীবর্মার ভাইপো, এবং চন্দ্রবর্মার চাচা।

 

সেই বল্লভসেন হরিকেল রাজ্যের “নতুন মহারাজ” নামে নিজেকে ঘোষণা করে। সে মানুষের উপর কঠিন কর বসায়, শস্য ছিনিয়ে নেয়, মন্দির ধ্বংস করে মূর্তি গলিয়ে ফেলে।

 

প্রজারা কান্নায় ভাসলেও কেউ বিদ্রোহ করার সাহস পায় না। হঠাৎ একদিন গুজব ছড়ায় — **"পুরনো রাজার ছেলে ফিরেছে।"**

  

## অধ্যায় ৪: আগুনের মুখোমুখি প্রেম

 

চন্দ্রবর্মা যখন ২২ বছর বয়সে প্রথমবার রাজধানীর বাইরে ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে হাজির হন, তখন লোকেরা ভয় আর আশা—দুটো নিয়েই তাকায়।

 

কিন্তু এই যুদ্ধে তার সামনে পড়ে একজন — বল্লভসেনের কন্যা **রূপমঞ্জরী**। সে পিতার পক্ষে সৈন্য নিয়ে লড়াই করছিল, কিন্তু চন্দ্রবর্মার বীরত্বে হার মানে।

 

রূপমঞ্জরী আহত হয়, এবং চন্দ্রবর্মা নিজে তার জীবন রক্ষা করে। এই ঘটনা থেকে জন্ম নেয় এক অসম্ভব প্রেম, যা **রাজনীতি আর প্রতিশোধের মাঝখানে দাঁড়িয়ে**।

 

রূপমঞ্জরী তাকে বলে:

 

 

**"তুমি চাইলে আমি পিতাকে ত্যাগ করবো। কিন্তু তোমাকে সত্যিকারের রাজা হতে হবে—সহানুভূতিশীল, প্রতিশোধের বাইরে।"**

 

চন্দ্রবর্মা দ্বিধায় পড়ে — প্রেম, ন্যায় আর প্রতিশোধ একসাথে মেলানো কি সম্ভব?

  

## অধ্যায় ৫: তিন বছর তপস্যা — এক ‘অদৃশ্য রাজা’

 

প্রেমের দ্বিধা আর রাজনীতির দুর্বোধ্য জালে চন্দ্রবর্মা নিজেকে সরিয়ে নেন। তিনি চলে যান পাহাড়ি অঞ্চলে। সেখানে তপস্যা করে, গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তোলে, প্রজাদের বিশ্বাস অর্জন করেন এবং এক ‘ছায়া রাজ্য’ গড়ে তোলেন।

 

লেখচিত্র, চিঠি, রটনা — সবই বলছিল, **একজন অদৃশ্য রাজা উঠে আসছে হরিকেলকে ফিরিয়ে আনতে।**

  

## অধ্যায় ৬: মহাযুদ্ধ — বৃকুটিনগরের পতন

 

চন্দ্রবর্মা শেষপর্যন্ত ঘোষণা দেন: **“হরিকেলকে মুক্ত করতেই হবে।”**

 

তিনপথে ভাগ করা বাহিনী নিয়ে তিন কুলীন জমিদারের ঘাঁটিতে আঘাত হানে। তারপর বল্লভসেনের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ হয় বৃকুটিনগরের প্রাচীন দুর্গের সামনে।

 

এই যুদ্ধে রূপমঞ্জরী আবার আসে, কিন্তু এবার সে চন্দ্রবর্মার পক্ষ নিয়ে

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে বল্লভসেন বন্দি হন। চন্দ্রবর্মা তাকে হত্যা করেন না। তিনি বলেন:

**"তুমি আমার রক্তের লোক। মৃত্যুর চেয়ে কঠিন বিচার হলো ক্ষমা দিয়ে ত্যাগ করা।"**

 

## অধ্যায় ৭: রাজ্যপুনঃস্থাপন ও ইতিহাসের নীরবতা

চন্দ্রবর্মা হরিকেলকে আবার একত্রিত করেন। নতুন সংবিধান তৈরি করেন, যেখানে রাণী রূপমঞ্জরী-র পাশে তিনি শাসন চালান ন্যায় ও সৌন্দর্যের ছোঁয়ায়।

 

কিন্তু তার শর্ত ছিল — **"আমার নাম ইতিহাসে লেখা হবে না। আমার কাজ থাকবে মানুষের মনে।"**

 

তাই ইতিহাসের বইয়ে চন্দ্রবর্মার নাম মুছে গেছে, কিন্তু পাহাড়ি গ্রামে আজও একটি গান শোনা যায়:

**"চন্দ্র যেমন আসে অন্ধকারে, বর্মা এল বুকে আগুন নিয়ে— যুদ্ধে জিতেও সে রক্ত মুছল প্রেমের হাতে।"**

Comments