ছানা বেচনা: এক ইউনিয়নের প্রেম, সংগ্রাম ও বিজয়ের গল্প

লেখক : মাসুম 

ব্লগ : EditorPosts

ছানা বেচনা, ছানা বেচনা

একটি ইউনিয়নের গল্প

অধ্যায় ১: ছানার ঝাঁপি আর রবিউলের গলা

চাঁদের আলোয় ডুবে থাকা চর কুটিরপাড় যেন নিস্তব্ধ এক উপন্যাসের পাতা। তার মাঝখানে বয়ে চলে একটানা নদী আর মানুষের জীবন। সেই জীবনপথেই হাঁটে রবিউল—এক হাতে বাঁশের ঝাঁপি, মুখে গলা টেনে বলে,
“ছানা বেচনা, ছানা বেচনা! মায়ের ছানা, গলার সোনা!”

এই ডাকটা নতুন কিছু নয়। গত পাঁচ বছর ধরে ইউনিয়নের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়, হাটে-বাজারে রবিউলের গলা যেন এক পরিচিত সুর। তার ছানা শুধু ছানা নয়, অনেকের জন্য বেঁচে থাকার স্বাদ, অনেকের জন্য বিকেলের আড্ডা, আবার অনেকের স্মৃতির গন্ধ।

অধ্যায় ২: মায়ের ছানা

রবিউল যখন সাত বছরের, তখন নদীর জলে তার বাবা হারিয়ে যায়। মা ছানার ব্যবসা করতেন। খাঁটি দুধ, নিজ হাতে বাঁধানো ছানা, আর হাসিমুখে বেচাকেনা—এই নিয়েই চলতো সংসার। রবিউল বড় হতে হতে ছানা বানানো শিখে ফেলে।

মা বলে,
“বাবা, ছানার মধ্যে যেন তোমার মন থাকে। মন থাকলে ছানাও মিষ্টি হয়।”
রবিউল মায়ের কথা রাখে।

তার বানানো ছানার নাম – “মায়ের ছানা”। এই ছানার বৈশিষ্ট্য হলো – নরম, লবণসিক্ত, গুড়ের সামান্য ছোঁয়া, আর একফোঁটা বিশ্বাস।

অধ্যায় ৩: হাটের ডাক আর ফিরোজ মিয়ার আগমন

চর কুটিরপাড় হাট এখন অনেক জমজমাট। বড় বড় দোকান, বাইরের মাল, শহরের মিষ্টি। হাটের এক কোণে বসেছে নতুন দোকান – ফিরোজ মিয়া মিষ্টির ঘর। সে শহর থেকে এসে বলছে, “এই গ্রামে আমি শহরের স্বাদ আনবো।”

রবিউলের ‘মায়ের ছানা’ হাটে দারুণ চলছে দেখে ফিরোজ মিয়া ঈর্ষান্বিত হয়। হাটে একদিন বলে বসে,
“এই যে ছানাওয়ালা! এইসব গ্রামীণ জিনিস নিয়ে কেউ বড় হতে পারে না।”
রবিউল হেসে উত্তর দেয়,
“গ্রামই মায়ের কোলে জন্মানো যায়গা, ভাই। এখানেই বড় হই।”
হাটের লোকজন হেসে ওঠে, করতালি পড়ে।

অধ্যায় ৪: প্রেমের শুরু, লাইলীর আগমন

এক হাটবারেই হালিমপুর থেকে আসে এক মেয়ে—লাইলী। তার বাবা কামাল মিয়া গরুর খামারি। দুধ বেচতে এসে রবিউলের ছানার ঝাঁপিতে নজর পড়ে তার।
লাইলী বলে, “এই ছানার গন্ধ তো অন্যরকম।”
রবিউল হেসে জবাব দেয়, “এই ছানায় আমার মায়ের স্মৃতি, আর একটু প্রেমের ইশারা আছে।”

ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুইজন চুপিচুপি দেখা করে বাঁশঝাড়ের পাশে, হাওরের ধারে। লাইলী রবিউলকে চায়, আর রবিউল তার স্বপ্ন দেখে—একটা ছোট ঘর, ভেতরে ছানার গন্ধ আর পাশে লাইলীর হাসি।

অধ্যায় ৫: বেদনার ঢেউ

শুধু প্রেমে বাধা নয়, হিংসাও আসে সঙ্গে। ফিরোজ মিয়া লাইলীর বাবাকে নানা মিথ্যে বুঝিয়ে বলে—
“ছানাওয়ালা ছেলে, ভবিষ্যৎ নাই। আমি শহরের ট্রেনিং করা লোক, দোকান আছে, টাকা আছে।”

কামাল মিয়া একদিন মেয়েকে বলে,
“তুই ফিরোজকে বিয়ে করবি। শহরের মতো ঘরে থাকবি। ছানাওয়ালা দিয়ে কি হয়?”
লাইলী কাঁদে, রবিউল কিছু বলতে পারে না।

এক সন্ধ্যায় রবিউল হাট থেকে ফিরে দেখে, লাইলীর বিয়ে ঠিক হয়েছে। মায়ের চোখেও জল, কারণ তিনিও জানেন—এই প্রেম আর হবে না।

অধ্যায় ৬: ছানার বিপ্লব

রবিউল ভেঙে পড়ে না। সে জানে, প্রেমে হার মানলে জীবনেও মানতে হয়। সে ছানা বিক্রির পাশাপাশি শুরু করে “গ্রামীণ স্বাদ” নামে একটা ঘুর্নায়মান ছানার ঠেলা। ইউনিয়নের প্রতিটি পাড়ায় সে ঠেলা নিয়ে যায়। শুরু করে ছানা + গল্প + গান – এক অভিনব পদ্ধতি।

লোকজন দাঁড়ায়, ছানা খায়, গল্প শুনে। কেউ বলে, “রবিউল ভাই, আপনি মঞ্চে উঠলেই পারতেন!”
রবিউল হেসে জবাব দেয়, “এই ঠেলাই আমার মঞ্চ, ভাই।”

অধ্যায় ৭: মায়ের অসুস্থতা ও চ্যালেঞ্জ

এমন এক সময়ে রবিউলের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার বলে – কিডনির সমস্যা। টাকা দরকার অনেক।
রবিউল ছানা বিক্রি বাড়িয়ে রাতেও শুরু করে হাটে-বাজারে ঘোরা।

লোকজন খুশি হয়ে তার পাশে দাঁড়ায়। কেউ ছানা বেশি দাম দিয়ে কিনে, কেউ গোপনে টাকা দিয়ে সাহায্য করে।

অধ্যায় ৮: ইউনিয়নের নির্বাচন ও রবিউলের বিপ্লব

চর কুটিরপাড়ে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন আসে। লোকজন চায়, রবিউল দাঁড়াক।
“ছানা বেচা ছেলে? মেম্বার?”—হাসাহাসি শুরু হয়।
কিন্তু হাটে একদিন রবিউল বলে,

“আমি ছানা বেচি ঠিকই, তবে মিথ্যে বেচি না। আমি ঠেলা চালাই ঠিকই, তবে লোভের চাকা ঘোরাই না।
আমি যদি কখনও আপনার দরজায় ছানা দিতে না পারি, অন্তত সত্য বলতে পারি।”

লোকজন চিৎকার করে—“রবিউল ভাইকেই চাই!”

অধ্যায় ৯: জয় এবং নতুন যাত্রা

রবিউল নির্বাচনে জিতে যায়। ফিরোজ মিয়া হেরে গিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।
লাইলীর বিয়ে হয়নি—ফিরোজের চরিত্র ফাঁস হওয়ায় বিয়ে ভেঙে যায়।
একদিন হাটে রবিউল আবার বলে,
“ছানা বেচনা, ছানা বেচনা! মায়ের ছানা, গলার সোনা!”

এবার তার পাশে দাঁড়িয়ে লাইলী, হাতে ছানার ঝাঁপি, মুখে হাসি।


উপসংহার

এই গল্প শুধু ছানা বিক্রির না, বরং একজন গ্রামের তরুণের স্বপ্ন, ভালোবাসা, হার না মানা মন আর সামাজিক পরিবর্তনের গল্প। ছানার মতো নরম হলেও এই গল্পের ভিত এতটাই শক্ত যে শহরের দালানকেও টলে দিতে পারে।


গল্পটি ভালো লাগলে কমেন্ট করতে ভুলবেন না 

Comments