গল্পের নাম: নির্জন রেলস্টেশন

লেখক : মাসুম

ব্লগ : EditorPost



প্রথম অধ্যায়: শুরুটা ছিল একা

রেলস্টেশনটা যেন একেকটা নিঃসঙ্গ বিকেল বুকে বয়ে বেড়ায়। ধোঁয়া ওঠা চা আর ট্রেনের সিটি ছাড়া এখানে আর কোনো জীবনের শব্দ নেই। ঠিক এইরকম এক বিকেলে পলাশ নামের ছেলেটি নেমে পড়ে এই স্টেশনে। হাতে একটা ব্যাগ, চোখে ধোঁয়াশা ভবিষ্যতের সন্ধান।

পলাশ শহর ছেড়ে এসেছে। আসার পেছনে আছে এক দীর্ঘ বিশ্বাসভঙ্গ, এক ভেঙে যাওয়া প্রেম, আর সেই মানুষগুলোর অন্ধকার মুখ, যাদের সে বন্ধু ভাবত। সে ভেবেছিল শহরটা তার হবে, কিন্তু শহর জানিয়ে দিয়েছে—কারো কিছু নয় এই দুনিয়ায়।

ছোট এই স্টেশনের পাশেই একটা ভাঙাচোরা দোকানে চা খেতে খেতে পলাশ ভাবছিল—এখানে এসে কী পেল? কিংবা এখানে থাকবেই বা কেন? কিন্তু জীবনের প্রশ্নের উত্তর তো কখনও এক কাপ চায়ে মেলে না, তবে কিছুটা শান্তি বটে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: মিনা বালা ও পুরাতন লাইব্রেরি

স্টেশনের পাশে একটা পুরনো লাইব্রেরি। নাম “আলোকবর্তিকা পাঠাগার”। সেখানেই পরিচয় হয় মিনা বালার সঙ্গে। বইয়ের ঘ্রাণে মোড়া সেই মেয়েটির চোখে ছিল একরাশ দুঃখ, আর ঠোঁটে হালকা হাসি।

মিনা বালার গল্পটাও কম নয়। সে এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। স্বপ্ন ছিল অধ্যাপনা, কিন্তু জীবন তাকে এনে ফেলেছে এই নির্জন লাইব্রেরিতে। পলাশ প্রতিদিন বই নিতে আসত, আর একটু একটু করে তাদের মধ্যে তৈরি হয় এক অলিখিত বন্ধুত্ব।

তৃতীয় অধ্যায়: বন্ধু না বিশ্বাসঘাতক?

একদিন হঠাৎ শহর থেকে আসে অরবিন্দ—পলাশের পুরনো বন্ধু। কিন্তু সে এসেছিল ক্ষমা চাইতে নয়, বরং মনে করিয়ে দিতে—যারা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে, তারা ঠকে। সে আবারও প্রস্তাব দেয়, ফিরে চলো শহরে, আমরা আবার সব শুরু করব।

কিন্তু পলাশ জানে, ফিরে যাওয়া মানেই আবার সেই কষ্ট, সেই মানুষদের মুখ দেখা—যাদের বিশ্বাস করেই সে ভেঙেছিল। তাই সে না বলে দেয়।

চতুর্থ অধ্যায়: পুরনো প্রেমের চিঠি

মিনা একদিন পলাশকে একটা চিঠি দেয়। সেটা ছিল মিনার প্রথম প্রেমিকের লেখা, যাকে সে হারিয়েছে ট্রেন দুর্ঘটনায়। সেই চিঠির ভাষা ছিল এমন—যা যেন পলাশের নিজের কথাও হতে পারত।

চিঠির লাইন ছিল: “তুমি যদি কখনও ফিরে এসে আমাকে না পাও, জেনে নিও—আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম শেষ দিন পর্যন্ত।”

পলাশ সেই রাতে ঘুমাতে পারেনি। যেন নিজের জীবনের প্রতিফলন দেখছিল অন্য কারো হাতে লেখা শব্দে।

পঞ্চম অধ্যায়: একটি ঝড়ো রাত

এক রাতে প্রবল ঝড় হয়। ট্রেন বন্ধ, বিদ্যুৎ নেই, চারিদিকে নীরবতা। সেই রাতে পলাশ আর মিনা লাইব্রেরিতে আগুন থেকে বাঁচাতে গিয়ে আটকে যায়। বই বাঁচাতে গিয়ে হাত পুড়ে যায় পলাশের, আর সেই সময়ে মিনা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে: “তুমি কি পারবে আমাকে আর একবার বিশ্বাস করতে?”

পলাশ মাথা নাড়ে। এই প্রথম সে নিজের ভিতর আর কিছু লুকায় না।

ষষ্ঠ অধ্যায়: পুরনো শহর ফিরে দেখা

কয়েক সপ্তাহ পর, পলাশ মিনাকে নিয়ে শহরে আসে। পুরনো রাস্তাগুলো, বন্ধুবান্ধব, অফিস — সবকিছু একেবারে অপরিচিত মনে হয়। এক সন্ধ্যায় তারা পুরনো রেস্টুরেন্টে যায়, যেখানে পলাশ ওর সাবেক প্রেমিকাকে প্রথম প্রপোজ করেছিল। মিনা চুপচাপ ছিল।

“ভয় পাচ্ছ?” পলাশ জিজ্ঞেস করে। “না, ভাবছি—তুমি তখনও হাসতে পারতে, আজও পারো,” মিনা উত্তর দেয়।

সপ্তম অধ্যায়: পাঠাগারের পুনর্জন্ম

ফিরে এসে তারা লাইব্রেরিকে নতুন করে সাজায়। পুরাতন বই, নতুন পাঠক, শিশুদের জন্য আলাদা কোণা। তারা শিশুদের গল্প বলার ক্লাস শুরু করে, যেখানে পলাশ নিজের অভিজ্ঞতা গল্প করে।

তারা একটি ছোট পত্রিকা বের করে—নাম “রেলগাড়ির চিঠি”, যেখানে স্থানীয়রা নিজেদের লেখা, কবিতা আর গল্প জমা দেয়। পাঠাগার হয়ে ওঠে গ্রামের প্রাণকেন্দ্র।

অষ্টম অধ্যায়: বিচ্ছেদের রেললাইন

কিন্তু সুখ বেশিদিন থাকে না। মিনা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। চিকিৎসা ব্যয়বহুল। শহরে নিতে হবে, কিন্তু লাইব্রেরির আয় যথেষ্ট নয়। পলাশ আবার শহরে ফিরে গিয়ে পুরাতন বন্ধুর সাহায্য চায়।

অরবিন্দ এবার সত্যিই সাহায্য করে। তবে শর্ত থাকে—পলাশকে ফিরতে হবে, অন্তত একটা চাকরির জন্য। পলাশ মেনে নেয়, কিন্তু জানে সে স্থায়ী নয়।

নবম অধ্যায়: ফিরে আসা ও প্রতিজ্ঞা

মিনার চিকিৎসা শেষে, পলাশ প্রতিজ্ঞা করে, আর কোনোদিন সে মিনাকে ছেড়ে যাবে না। তারা মিলে পাঠাগারে একটি নতুন শাখা খোলে—“বিশ্বাস ঘরে”—যেখানে মানুষ এসে নিজের জীবনের গল্প রেখে যেতে পারে।

এই বিশ্বাস ঘরে মানুষের কান্না, হাসি, প্রেম আর প্রতারণার কাহিনি জমে ওঠে। আর পলাশ জানে, সে তার নিজের গল্পের শেষ অধ্যায় এখানেই লিখবে।

শেষ অধ্যায়: ট্রেন ছুটে যায়, দু’জন রয়ে যায়

শেষ পর্যন্ত শহর থেকে আবার ডাক আসে। পলাশের চাকরি, পরিবার, সব কিছু ফিরে পেতে পারত। কিন্তু সে থেকে যায়। মিনা আর পলাশ মিলে গড়ে তোলে এক নতুন পাঠাগার—নতুন নাম “আলোকরেখা পাঠাগার”। কারণ, তারা জানে, সত্যিকারের আলো কেবল বইয়ের পাতায় নয়, সম্পর্কের গভীরতাতেও থাকে।

গল্পের সারমর্ম:

"নির্জন রেলস্টেশন" শুধুমাত্র একটি প্রেমগল্প নয়। এটি বিশ্বাস, প্রতারণা, ক্ষমা, এবং আত্ম-উদ্ধারের এক যাত্রা। যেখানে ট্রেন কেবল যাত্রী বহন করে না, বহন করে স্মৃতি, কান্না, ভালোবাসা এবং নতুন আশার চাবি।

Comments