ধ্বংসের আগে: সম্রাজ্ঞী বিশাখার শেষ যুদ্ধ
লেখক : মাসুম
ব্লগ : EditorPost
(একটি প্রাচীন বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস থেকে অনুপ্রাণিত গল্প)
ভূমিকা: ইতিহাসের অন্ধকার থেকে এক কণ্ঠস্বর
বাংলার ইতিহাস অসংখ্য গৌরবময় অধ্যায়ে ভরা। কখনো তা পালদের সভ্যতা, কখনো সেনদের প্রতাপ।
কিন্তু কিছু নাম — কিছু আত্মত্যাগ — সময়ের ধুলায় হারিয়ে গেছে।
এই গল্প সেইরকমই এক হারিয়ে যাওয়া রাণী বিশাখার,
যার মৃত্যু দিয়েই শেষ হয়েছিল একটি গৌরবময় নগরীর ইতিহাস।
প্রথম অধ্যায়: উষাকাল
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী।
গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরে ছড়িয়ে থাকা রাজ্যগুলো তখন ছোট ছোট রাজত্বে বিভক্ত।
পূর্ব বাংলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করতেন মহারাজ ধর্মপাল।
তিনি ছিলেন শক্তিশালী, কিন্তু বয়সের ভারে ক্লান্ত।
তার একমাত্র উত্তরসূরী — রাজকুমারী বিশাখা।
অবিশ্বাস্য রূপের অধিকারিণী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী এবং দুর্দান্ত ঘোড়সওয়ার।
বিশাখা ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি আর যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত।
তিনি জানতেন, এই সময়ে মেয়েদের জন্য সিংহাসন দখল সহজ কাজ নয়।
বিশাখার স্বপ্ন ছিল — বাংলাকে একত্রিত করে এক অদম্য সাম্রাজ্য গড়ে তোলা।
দ্বিতীয় অধ্যায়: বিশ্বাসঘাতকতার বীজ
ধর্মপাল বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। সভাসদরা তখন বিশাখার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠলেন।
"এক নারী কখনো রাজ্য শাসন করতে পারবে না,"
— বারবার উঠত এই কুৎসিত ফিসফাস।
বিশাখার প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল সেনাপতি বীরদত্তের।
তিনি মনে করতেন, বিশাখা-ই পারে বাংলাকে রক্ষা করতে।
কিন্তু সভাসদ বৃন্দ এবং কিছু প্রভাবশালী জমিদার ষড়যন্ত্র করছিলেন।
তাদের নেতৃত্বে ছিলেন একজন: মন্ত্রী কেশব।
কেশবের ছিল রাজ্য দখলের লালসা। বিশাখাকে সরিয়ে দিতে তিনি গোপনে পার্শ্ববর্তী রাজ্য কামরূপের রাজা বিক্রমের সাথে যোগাযোগ করলেন।
পরিকল্পনা সহজ — বিশাখাকে সরিয়ে দিলেই, তিনি পুতুল রাজার মাধ্যমে দেশ চালাবেন।
তৃতীয় অধ্যায়: যুদ্ধের ছায়া
বিশাখা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছিলেন।
তিনি দ্রুত সেনাবাহিনী সংগঠিত করলেন।
রাজ্যবাসীর মধ্যে বিশাখার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ছিল।
তাদের বিশ্বাস ছিল, বিশাখার হাত ধরেই নতুন সকাল আসবে।
কিন্তু সময় ছিল কম।
কামরূপের বিশাল বাহিনী তখন সীমান্ত অতিক্রম করছিল।
বিশাখা বুঝলেন, এ যুদ্ধ তাঁর জন্য শুধু রাজ্য রক্ষার লড়াই নয় —
এ যুদ্ধ তাঁর অস্তিত্বের লড়াই।
চতুর্থ অধ্যায়: প্রেম ও বিচ্ছেদ
যুদ্ধের আগের রাতে, বীরদত্ত বিশাখার কাছে এলেন।
তিনি দীর্ঘদিনের প্রেম অনুভব করতেন, যা কখনো প্রকাশ করেননি।
সেই রাতে প্রথমবার বিশাখার চোখে জল এলো।
"আমি জানি, কালকের সূর্য হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না," বীরদত্ত বললেন,
"কিন্তু তোমার জন্য আমি যুদ্ধ করবো, প্রিয়তম।"
বিশাখা হাসলেন, যেন হাজারো অশ্রু গিলে।
"প্রেমের জন্য নয়, বীরদত্ত," তিনি বললেন,
"আমাদের জাতির জন্য লড়ো। আমার নাম নয়, বাংলার ইতিহাস বাঁচাও।"
পঞ্চম অধ্যায়: রক্তঝরা ভোর
ভোরবেলা যুদ্ধ শুরু হলো।
কামরূপের সেনারা সংখ্যায় ছিল বিশাখার বাহিনীর তিনগুণ।
তবুও বিশাখা, সাদা ঘোড়ার পিঠে দাঁড়িয়ে, সেনাদের উজ্জীবিত করলেন।
তিনি নিজেই তরবারি হাতে প্রথম সারিতে নেতৃত্ব দিলেন।
যুদ্ধ ভয়াবহ ছিল। মাটি লাল হয়ে গেল রক্তে।
বীরদত্ত আহত হলেন। বিশাখা নিজ হাতে তাঁকে নিরাপদ স্থানে পাঠালেন।
তিনবার বিশাখার ঘোড়া আহত হলো, তবুও তিনি পিছু হটলেন না।
কিন্তু কেশবের বিশ্বাসঘাতকতা তখন চূড়ান্ত রূপ নিল।
রাজ্যের ভেতর থেকে গোপন দরজা খুলে দিল মন্ত্রীরা।
কামরূপের সেনারা রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়ল।
ষষ্ঠ অধ্যায়: শেষ প্রহর
রাজপ্রাসাদ ঘিরে ফেলা হলো।
বিশাখা জানতেন, পরাজয় নিশ্চিত।
তবুও তিনি আত্মসমর্পণ করলেন না।
রাজপ্রাসাদের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত লড়লেন।
শেষ মুহূর্তে কেশব সামনে এলেন।
"তুমি হেরে গেছো, মহারাণী," সে বলল।
বিশাখা শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন,
"হারা তাদেরই হয় যারা বিশ্বাস হারায়। আমি না।"
নিজ হাতে নিজের হৃদয়ে ছুরি চালালেন বিশাখা।
আর রাজপ্রাসাদ জ্বলে উঠল আগুনের লেলিহান শিখায়।
তার মৃত্যুর সাথে সাথে বাংলার সেই স্বাধীনতা শেষ হয়ে গেল।
পরিশিষ্ট: হারিয়ে যাওয়া রাজ্যের কাহিনী
কালের আবর্তে বিশাখার রাজ্যের নামও হারিয়ে গেছে।
শুধু গঙ্গার নির্জন এক বাঁকে আজও নাকি রাতে বাতাসে ভেসে আসে
ঘোড়ার খুরের শব্দ, তরবারির ঝনঝনানি, আর এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত হয়:
"বাংলা কখনো মাথা নত করে না।"
উপসংহার: ইতিহাস ভুলে গেলে জাতি মরতে শুরু করে
বিশাখা কোনো বইয়ের পাতায় নেই। কোনো রাজকীয় ইতিহাসে তার নাম লেখা হয়নি।
কিন্তু তার আত্মত্যাগ, তার দুর্বিনীত সাহস —
সেই চিরন্তন অনুপ্রেরণা হয়ে আছে,
যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকে — বাতাসের গন্ধে, নদীর ঢেউয়ে,
আর আমাদের রক্তে।
**আজ আমাদের দায়িত্ব — হারানো ইতিহাসের এই প্রদীপগুলোকে আবার জ্বালানো।**
[সমাপ্তি]
Comments
Post a Comment