রাজনৈতিক প্রতারণা: আদর্শ থেকে অবিশ্বাসের এক দীর্ঘ যাত্রা
লেখক : মাসুম
ব্লগ : EditorPost
শুরুর গল্প:
নাম তার সাগর। বয়স ত্রিশের কোঠায়। সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া সাগর ছোট থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলত। তার বাবার ছিল একটি ছোট বইয়ের দোকান আর মা ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা। বাড়ির দেওয়ালে ঝোলানো বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে সে বড় হয়েছে—আদর্শ, সততা আর মানুষের পাশে থাকার শিক্ষা পেয়েছে সেই ছোটবেলা থেকেই।
গ্রামের নাম ধলেশ্বরীপুর। শহর থেকে অনেকটা দূরে, কিন্তু মানুষজন শান্তিপ্রিয়। তবে শান্ত সেই চেহারার আড়ালে লুকিয়ে ছিল দীর্ঘদিনের অবহেলা—রাস্তা নেই, হাসপাতাল নেই, স্কুলে শিক্ষক সংকট, ঘরে ঘরে বেকারত্ব।
সাগর বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে শহরে যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গিয়ে সে প্রথম চেনে "রাজনীতি" নামের অদ্ভুত দুনিয়াকে। একদিকে মিছিল, প্রতিবাদ আর অন্যদিকে দখল, তোলাবাজি, ক্ষমতার মোহ। কিন্তু সাগর ভিন্ন পথ বেছে নেয়—সে আদর্শ ধরে রাখে।
স্বপ্নের বীজ:
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে ফিরে আসার পর সাগরের চোখে একটা আলাদা আগুন। সে দেখে, তার গ্রাম এখনও আগের মতো। দশ বছর আগেও যেমন ছিল, আজও তেমন। প্রশাসনের মুখ দেখাও কপালে জোটে না কারো। সাগর সিদ্ধান্ত নেয়—এই গ্রামকে বদলাবে।
সে শুরু করে ছোট ছোট সামাজিক উদ্যোগ—রক্তদানের ক্যাম্প, শিক্ষার্থীদের জন্য কোচিং, বয়স্কদের জন্য বিনামূল্যে চেকআপ। ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষের মুখে সাগরের নাম ছড়িয়ে পড়ে। সবাই বলে,
“এই ছেলে পারবে… এইবার ওর মতো কাউকেই দরকার।”
প্রথম নির্বাচনে দাঁড়ানো:
গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন আসে। পুরনো চেয়ারম্যান একসাথে তিনবার জয়ী—কিন্তু কাজ? প্রায় শূন্য। গ্রামের যুবসমাজ চায় পরিবর্তন। তারা সাগরের পেছনে দাঁড়ায়।
সাগর দলীয় টিকিট নেয়নি। সে প্রতিশ্রুতি দেয়,
“দল নয়, জনগণ হবে আমার আসল দল।”
গ্রামে প্রচার চলে হ্যান্ডমাইক হাতে, বাইসাইকেলে ঘুরে ঘুরে সে বলে:
“আপনারা আমার নেতা, আমি আপনার কর্মী। যদি জিতি, আপনারাই চালাবেন আমাকে।”
এই সত্যবাদিতা, সরলতা আর সাহসের জন্য সাগর প্রথম নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়। মানুষ খুশি—এ যেন একটা নতুন দিনের শুরু।
পরিবর্তনের ছোঁয়া:
জেতার পর সাগর হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। সে সরকারি প্রকল্প খুঁজে খুঁজে গ্রামে আনে—নতুন রাস্তা, টিউবওয়েল, স্কুল ভবন, একটানা ৩ বছরে তার গ্রাম যেন বদলে যায়। মিডিয়া আসে, সাগরের নাম পত্রিকায় ছাপা হয়। ঢাকার বড় দলগুলো চোখ রাখে তার ওপর।
এভাবেই শুরু হয় পরবর্তী অধ্যায়—যেখানে রাজনীতি আর প্রতারণার মুখোমুখি হয় সাগর।
লোভ ও ফাঁদ:
একটি বড় রাজনৈতিক দল সাগরকে আমন্ত্রণ জানায়। বলে,
“তোমাকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দাঁড় করাব। শুধু আমাদের হয়ে কথা বলো, মাঝেমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের মতো করে নিও।”
সাগর প্রথমে দ্বিধায় পড়ে। সে জানে, এই পদে গেলে কাজের সুযোগ বাড়বে, কিন্তু আদর্শ থাকবে তো?
তাকে বোঝানো হয়,
“বড় হওয়ার জন্য ছোট কিছু ছাড় দিতেই হয়।”
চিন্তা করতে করতেই সে রাজি হয়। সেই দলের হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে দাঁড়ায় এবং জয়ী হয়।
আসল খেলা শুরু:
চেয়ারম্যান হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই সে দেখতে শুরু করে ভিন্ন রূপ—
প্রকল্প বরাদ্দ পেতে হলে দলে কমিশন দিতে হয়, টেন্ডার আগে ভাগেই ঠিক হয়ে যায়, ফাইল নাড়াতে ঘুষ লাগে।
সাগর প্রতিবাদ করে, কিছু ফাইল আটকে দেয়। দলের সিনিয়ররা ডেকে বলে:
“তুই আমাদের হয়ে জিতেছিস, এখন আমাদের নিয়ম মানতেই হবে।”
তাকে হুমকি দেওয়া হয়—দল ছাড়লে মামলায় জড়ানো হবে। সাংবাদিকদের দিয়ে তার নামে সংবাদ ছড়ানো হয়:
“চেয়ারম্যান সাগর আত্মীয়দের নামে প্রকল্প দিয়েছেন!”
যা সম্পূর্ণ মিথ্যা—কিন্তু মানুষ বিভ্রান্ত।
বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা:
গ্রামের মানুষ যারা একদিন তার পাশে ছিল, তারাই আজ প্রশ্ন তোলে। কেউ ফোন ধরেনা, কেউ মুখোমুখি হলে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়।
একদিন এক মাদ্রাসার শিক্ষক সাগরের দিকে তাকিয়ে বলে:
“ছেলেটা কেমন বদলে গেল... আগে ছিল জনগণের প্রতিনিধি, এখন যেন দলের চামচা!”
সাগরের বুক ভেঙে যায়। সে জানে, সে সবটা হারায়নি, কিন্তু অনেকটা হারিয়েছে।
আত্মসংঘাত ও প্রতিকার:
একদিন গভীর রাতে সে তার বাবার ছবির সামনে বসে। বাবার কণ্ঠ যেন কানে বাজে,
“সত্যি পথে থাকলে হয়তো দেরি হয়, কিন্তু হার হয় না।”
সাগর সিদ্ধান্ত নেয়—সে আর এই মিথ্যার খেলায় থাকবে না।
পরের দিন সে সাংবাদিক সম্মেলন করে সব ফাঁস করে দেয়—ঘুষ, টেন্ডার সিন্ডিকেট, দলের চাপ, সব।
সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। তাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ে যায়।
কিন্তু গ্রামের সাধারণ মানুষ, যারা সত্য চেনে, তারা আবার সাগরের পাশে দাঁড়ায়।
শেষের আশার আলো:
আজ সাগর কোনো পদে নেই। সে নিজেই একটি ছোট এনজিও গড়ে তুলেছে—“আলোকপথ” নামে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন—এগুলোই তার অস্ত্র।
মানুষ আবার বিশ্বাস করছে তাকে, ধীরে ধীরে নতুন নেতৃত্ব গড়ছে।
সে বলে,
“রাজনীতি যদি হয় প্রতারণা, তবে আমি তার বিরুদ্ধে একমাত্র সত্যের সৈনিক।”
এই গল্পটা শুধু সাগরের না, এটা হাজারো তরুণের—যারা আদর্শ নিয়ে রাজনীতিতে আসতে চায়, কিন্তু মাঝপথে হারিয়ে যায়।
আমরা যদি তাদের পাশে না থাকি, তবে ভবিষ্যৎও কুয়াশায় ঢেকে যাবে।
Comments
Post a Comment