গল্পের নাম: “সময় যখন থেমে থাকে”
লেখক: মাসুম
ব্লগ: EditorPosts
ঢাকার ব্যস্ত জীবন। মোবাইল, মেট্রো, কফিশপ, আর ইনস্টাগ্রাম-রিলের শহর। এর মাঝেই বাস করত আরিয়া — একজন ইন্ট্রোভার্ট গ্রাফিক ডিজাইনার। সে সবসময় অনুভব করত যেন সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে, অথচ তার জীবনের কোথাও গতি নেই।
একদিন হঠাৎ করেই সে তার রুটিন ভেঙে পুরান ঢাকার এক পুরনো ঘড়ির দোকানে ঢুকে পড়ে। দোকানটি ছিল প্রায় অন্ধকার, দেয়ালজুড়ে পুরনো ঘড়ির টিক-টিক শব্দ। দোকানের এক কোণায় বসে ছিল একজন বৃদ্ধ — নীরব, ধূসর দাড়িওয়ালা এক মানুষ, যার চোখে সময়ের ইতিহাস লুকানো।
আরিয়ার চোখ আটকে গেল একটি ঘড়ির ওপর। সেটা ছিল একধরনের পকেট ঘড়ি — চকচকে রুপালী, যার কাঁটা থেমে আছে ঠিক ৩:১৭-তে।
“এই ঘড়িটা চলেনা?” — আরিয়া জিজ্ঞেস করল।
বৃদ্ধ মানুষটা মৃদু হাসল। “চলে না বললেই ভুল হবে। এটা সেই সময়েই থেমে আছে, যেই মুহূর্তে কারও জীবনে কিছু বদলে গিয়েছিল। ঘড়িটা সময় জমিয়ে রাখে।”
আরিয়া প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল, কিন্তু বৃদ্ধ লোকটা বলল, “তুমি যদি সাহস করো, তাহলে এই ঘড়িটা তোমাকে তোমার অতীতের একটা মুহূর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে — শুধু একবার, ঠিক যতক্ষণ ঘড়ির কাঁটা চলবে।”
সে ভাবল, এটা যদি সত্যি হয়? সে কি ফিরে যেতে চায়?
সে ঘড়িটি হাতে নেয়। চোখ বন্ধ করে ৩:১৭-তে থেমে থাকা মুহূর্তে ফিরে গেল। সে দেখতে পেল নিজের পুরনো কলেজ লাইব্রেরি, সেই নীরব করিডোর, আর সেখানে বসে আছে আদিন — সেই ছেলে যার সাথে একসময় চোখে চোখে প্রেম হয়েছিল, কিন্তু কখনো কথায় রূপ নেয়নি।
ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। ৩:১৮… ৩:১৯…
এই কয়েক মিনিটে আরিয়া সাহস করে আদিনকে ডাকে। তারা দুজন একসাথে হাসে, কথা বলে, আরিয়া অনুভব করে এই এক মিনিটেই তার ভিতরে জমে থাকা অনুশোচনার বরফ গলে যাচ্ছে।
৩:২০…
সবকিছু হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে গেল।
আরিয়া ফিরে এল বাস্তবে। হাতে সেই ঘড়ি, দোকানের ভিতরে এখন আর কেউ নেই, এমনকি সেই বৃদ্ধও না।
তার ফোনে তখন একটা নতুন মেসেজ — “তুমি আজ হঠাৎ মনে পড়লে, আর আমি হাসলাম… — আদিন”
আরিয়া জানত, সময় থেমে থাকে না। কিন্তু অনুভূতি? কিছু অনুভূতি কখনোই ফুরায় না।
এই গল্পের থিম:
ভালোবাসা, সময়, এবং অনুশোচনার মাঝে এক রহস্যময় বাঁক, যেখানে বাস্তবতা আর কল্পনার রেখা এক জায়গায় মিশে যায়।
সময় যখন থেমে থাকে – পর্ব ২: "আয়নার উল্টো পিঠ"
ঘড়িটি এখন আরিয়ার হাতে নেই। সেই পুরনো দোকানটিও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। দিন কয়েক পর সে আবার চেষ্টা করেছিল খুঁজে পেতে—পুরান ঢাকার সেই গলি, সেই কাঠের দরজা, সেই ধূসর দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ—কেউ নেই, কিছু নেই।
ঘড়িটি শেষবার সে যখন স্পর্শ করেছিল, তখন শুধু একটা ঝলক এসেছিল—কেউ যেন অন্য দিক থেকে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। ঠিক তারই মতো, কিন্তু মুখে ছিল এক অদ্ভুত শূন্যতা। সেই দিন থেকেই তার আয়নাটা যেন অদ্ভুতভাবে পাল্টে যায়।
ঘুম থেকে উঠে একদিন, আরিয়া নিজের আয়নায় তাকিয়ে হঠাৎ দেখতে পায়—ঘড়িটি এখন আয়নার ভেতরে।
আর আয়নার ও-পাশে দাঁড়িয়ে আছে... আরিয়াই। কিন্তু সে আরিয়া নয়। তার চোখে শূন্যতা, ঠোঁটে হালকা হেঁসে থাকা এক গা ছমছমে চেহারা।
“তুমি কে?” – আরিয়া ফিসফিস করে।
আয়নার ভেতরের আরিয়া বলে, “আমি সেই তুমি, যে সাহস করে আদিনকে কোনোদিন কিছু বলতে পারেনি। আমি সেই তুমি, যে এখনও সময়ের মধ্যে আটকে আছি। এবার আমার পালা—আমি ঘড়ি ঘোরাবো।”
আরিয়া ভয় পায়, কিন্তু কিছু বলতে পারে না। আয়নার ভেতরের ছায়া ঘড়ির কাঁটা ঘোরায়... আবার ৩:১৭...
আরিয়া চোখের সামনে দেখতে পায়, সময় আবার ফিরে যাচ্ছে—কিন্তু এবার সে নিজে কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ঘড়ির কাঁটা যেন উল্টো দিকে যাচ্ছে, আর সঙ্গে করে টেনে নিচ্ছে বাস্তবতা।
সে আবার সেই কলেজ করিডোরে ফিরে যায়। কিন্তু এবার, আদিন তাকে চিনতে পারে না। সে আরিয়া না—সে হয়ে গেছে আয়নার সেই ছায়া, যাকে কেউ চিনে না, কেউ দেখে না।
তার জীবনের গল্প এবার নতুনভাবে লিখছে "ছায়া-আরিয়া"।
সে বুঝে যায়—যে সময় ফিরে পেতে চায়, তাকে নিজের বর্তমান হারিয়ে দিতে হয়।
আর তাই...
ঘড়িটি এখন অন্য কাউকে খুঁজছে।আর আয়নায় যেই ঝাপসা চেহারা ভেসে ওঠে, সে জানে না—সে বাস্তব, নাকি কেবল সময়ের ভুল প্রতিফলন
শেষ নয়... শুরু মাত্র।
সময় যখন থেমে থাকে, সে শুধু স্মৃতি ফিরিয়ে আনে না... কখনো কখনো সে "অন্য" কে ফিরিয়ে আনে।
"এই লেখাগুলো মূলত কল্পনাপ্রসূত এবং শুধুমাত্র পাঠকের অনুভূতি জাগানোর উদ্দেশ্যে।"
Comments
Post a Comment